টাউনহল মোড়ে ২ শিশুকে আঁকড়ে ধরে লড়াই এক অসহায় নারীর
ইয়াছিন আরাফাত, স্টাফ রিপোর্টার
রাত যখন ৯টা ২০ মিনিট। কুমিল্লার টাউনহল মোড়। টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে রাস্তাঘাট। ফুটপাতে শুয়ে থাকা এক মহিলা, পাশে একটি ভেজা বাটি—তাতে কিছু ছেঁড়া টাকা। চারপাশে ছড়িয়ে আছে দুই শিশুর অস্থির নিশ্বাস।
ছোট্ট শিশুটি গভীর ঘুমে, বয়স মাত্র এক বছরের বেশি। তার শরীর ভিজে একাকার, তবুও ঘুম ভাঙছে না। বড় ছেলেটির বয়স আনুমানিক চার বছরের মতো। বৃষ্টির ভেতরে মায়ের কপালে কপাল ঠুকিয়ে অঝোরে ডাকছে,
“মা… মা…”
কিন্তু মায়ের কোনো সাড়া নেই। মাথা ও মুখ ওড়নায় ঢাকা, নিথর শরীর যেন কেবল বৃষ্টিকে আপন করে নিয়েছে। পথচারীরা ভেবে নিলেন—এ বোধহয় ভিক্ষাবৃত্তির কোনো কৌশল। বিরক্তি নিয়ে অনেকে ডাকাডাকি করলেন, কেউ উচ্চস্বরে চিৎকার করলেন। তবুও সাড়া মিললো না।
অবশেষে ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ ই মহিলাটি উঠে বসলেন। দ্রুত ছোট শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন, ওড়নায় মুছে দিলেন তার ভেজা শরীর। তারপর কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
কহন বিষ্টি আইলো, আমি বুজিনাই। আমার সইলডা খারাপ… আতে অনেক বিষ… কোনসুম যে ঘুমাইয়া পড়ছি জানিই না।
মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। ভিক্ষাবৃত্তির নাটক ভেবে যাকে সবাই অবহেলা করছিলেন, তিনি যে আসলে ক্লান্ত, অসহায় এক মা—তা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
এক নারী পথচারী সাহস সঞ্চয় করে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
এই বাচ্চাটিকে আমায় দিয়ে দিন। আমি ওকে যত্নে রাখবো। আপনার এতো কষ্ট করতে হবে না।
কিন্তু মা সন্তানের বুক চেপে ধরে দৃঢ় স্বরে উত্তর দিলেন,
না, না। আমি ওরে পড়ামু। ও আমারে ছাইড়া যাইবো না। ও আমারে থুইয়া থাকা পারবো না।
অভুক্ত পেট, ভিজে শরীর, অচল জীবন,তবুও সন্তানকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না তিনি। কারণ সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা যে সব অভাব-অভিযোগের ঊর্ধ্বে।
পরে উপস্থিত লোকজন মহিলাকে সন্তানদের নিয়ে কাছের একটি দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নিতে সহায়তা করেন। তবে বৃষ্টির সেই রাতের দৃশ্য পথচারীদের মনে রয়ে যায় গভীর প্রশ্ন হয়ে,
হে আল্লাহ, পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্য আর কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তুমি কি কেবল তাদেরকেই পরীক্ষা করো? নাকি আমাদেরকেও, তাদের জীবন দেখে কিছু শেখার জন্য।